আমরা অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে ফ্রীল্যান্সিং এর জন্য কাজ শিখেছি। অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোর্স করে কাজ শিখেছি আবার অনেকে বিভিন্ন বাংলা টিউটোরিয়াল এর মাধ্যমেও কাজ শিখেছি। কিন্তু যারা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ফ্রীল্যান্সিং বা অনলাইনে কাজ করার জন্য কাজ শিখে থাকেন তাদের মধ্যে অনেককেই বলতে শুনা যায় যে, আমি তো খালি বিডই করে যাচ্ছি কিন্তু কাজ তো পাচ্ছি না। আবার একই জায়গা থেকে কাজ শিখে কেউ কেউ ১-২ সপ্তাহের মধ্যেই কাজ পেয়ে যান। আবার নতুনদের মধ্যে অনেকেই কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে বলে থাকেন, এখন আর নতুনরা নাকি কাজ পায় না।
কিন্তু বাস্তবতাটা কি?
নতুনদের মধ্যে কাজ না পাওয়ার হতাশা যতখানি রয়েছে তার থেকে কয়েক গুন বেশি হতাশা দেখা যায় ক্লাইন্টদের মধ্যে। আপনি কাজ না পেয়ে যতটা না বেশি হতাশ তার থেকে অনেক গুণ বেশি হতাশ এই মার্কেটপ্লেস গুলোর ক্লাইন্ট, কারন তারা দক্ষ কর্মী খুজে পায় না। কথাটা হয়ত আজব মনে হবে কিন্তু এটাই বাস্তবতা এবং এর সাক্ষী আমি নিজে। এই কিছুদিন আগেই একটা একটু ব্যতিক্রমধর্মী এক কাজের জন্য ওয়ার্কার খুজতে গিয়ে আমি ৩ বার ফ্রীল্যান্সার.কম এ জব টিউন করি, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ১ জন উপযুক্ত লোক ও খুজে পাই নি কাজের জন্য। তাহলে এখন আপনি কিভাবে বলবেন যে, মার্কেটপ্লেস গুলোতে কাজ পাওয়া যায় না?
তাহলে কি করব?
প্রথেমেই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আপনি কতটুকু শিখেছেন? কত দিন ধরে চেস্টা করেছেন? একটু ভাবুন তো, বাস্তব জীবনে ২০-২৫ হাজার টাকার একটা চাকরী করার জন্য আমরা ২০-৩০ বছর বইয়ের বোঝা বহন করে দিন রাত পরিশ্রম করেও শেষমেশ ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তায় ভূগি, আর তাহলে ইন্টারনেট থেকে মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আর করার জন্য আপনি কি ৬ মাস কস্ট করতে প্রস্তুত নন? এখন আবার অনেকেই হাসবেন, যে, মাত্র ৬ মাসে ৫০ হাজার টাকা মাসে আয় করব? এইটা কি ছেলে খেলা নাকি, কিন্তু এটাই সত্য। আপনি যদি ৬ মাস ভাল করে পরিশ্রম করতে পারেন তাহলে অবশ্যই ৬ মাস পরে আপনি মাসে ৫০ হাজার+ আয় করতে পারবেন। তাহলে এবার ভাবুন, আপনি কি নিজেকে ওই রকম দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন?
আপনাদের কিছু মানসিকতা এবং আমাদের কিছু অভিজ্ঞতাঃ
আমাদের মধ্যে সবচাইতে বেশি যে প্রবণতাটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে, অল্প শিখে বেশি আয় করার চিন্তা। আমাদের যারা শিক্ষার্থী রয়েছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আমাদের থেকে টিউটোরিয়াল ডিভিডি কেনার পরে ৫-১০ দিনের মধ্যে আমাদের সম্পূর্ণ ডিভিডি টি দেখে শেষ করে ফেলে এবং ডিভিডি দেখা শেষ হলেই তারা মনে করে থাকে যে, কাজ শিখে ফেলেছি, এবার শুধু বিড করব আর কাজ করব এবং মাস শেষে হাজার হাজার ডলার গুনব। কিন্তু অবশেষে ফল হয় শূন্য। না জানার কারনে ফ্রীল্যান্সিং মার্কেটে কাজই পায় না। আর তখন, সকল দোষ হয় আমাদের,তখন তারা বলে থাকে, আমাদের ডিভিডি দেখে কিছুই শিখতে পারে নাই, অনলাইনে কাজ করা যায় না, এখানে কাজ পাওয়া যায় না, এটা ভূয়া এই ধরনের আরও অনেক কিছু। তবে আমাদের যারা ফ্রীল্যান্সিং শিখিয়ে থাকি তাদের জন্য এটা সান্তনার যে, এটা শুধু আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, দেশের সকল ফ্রীল্যান্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কপালেই এই ধরনের অপবাদ জোটে।
নতুনদের মধ্যে থাকা আরও একটু ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে,কোন সমস্যা হলে সেটার উত্তর নিজে নিজে না খোজার চেস্টা করা। আমাদের একটি সহজ অভ্যাস রয়েছে, যেখানে আমরা দুর্বল পাই, সেখানেই আঘাত করতে পছন্দ করি। কোন একজন ভাল শিক্ষক পেয়েছি কিনা, কোন ছোট খাট সমস্যা হলেও তার কাছেই জিজ্ঞেস করি। কারন, তিনি তো হেল্প করেন। কিন্তু এমনটা করার কারনেই আমরা কিছু শিখতে পারি না। নিজের সমস্যার সমাধান যদি নিজে বের করার মানসিকতা তৈরি না হয় তাহলে কোন দিনই উপরে উঠা সম্ভব নয়। আর কারন শরণাপন্ন কেবল তখনি হবেন যখন আপনি আপনার সমস্যার সমাধান অনেক চেস্টার পরেও পাবেন না। গুগলকে ব্যবহার করতে শিখুন সমস্যা সমাধানের জন্য, দেখবেন জীবন বদলে যাবে।
এইগুলা গেল অনেক বেসিক লেভেল, এইবার চলুন দেখি যারা বিড করে যাচ্ছেন কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না কেন?
ফ্রীল্যান্স মার্কেটপ্লেসে ঢোকার আগে প্রথম শর্ত হচ্ছে, আপনাকে দক্ষ হতে হবে। আপনি যে সেক্টরেই কাজ করুন না কেন, সেই সেক্টরে মিনিমাম ৫ টি সফল প্রোজেক্ট সম্পন্ন করেই তবে ফ্রীল্যান্সিং মার্কেটে কাজ করার চিন্তা করবেন। এখন আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, নতুন অবস্থায় ৫ টি প্রজেক্ট করার জন্য কাজ পাব কোথায়? এটার ও ব্যবস্থা আছে, আপনি লোকাল কারও কাজ করুন, অথবা নিজে নিজেই কয়েকটি প্রোজেক্ট বানিয়ে সেটাতে কাজ করুন। যেমন ধরুন- আপনি ওয়েব ডিজাইন শিখবেন, তাহলে আগে ৫টি ওয়েব সাইট তৈরি করুন, কারন এই ৫ টি প্রোজেক্ট আপনাকে মার্কেটপ্লেসে কাজ পেতে সাহায্য করবে।
এবার আসা যাক বিড কিভাবে করবেন সেটার উপর?
মার্কেট প্লেসে কাজ পাওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে একটু সাজানো গোছানো ছোট্ট এবং চমৎকার কভার লেটার। কারন, আপনি যখন কোন কাজে বিড করবেন তখন ক্লাইন্ট সর্বপ্রথম আপনার বিডের কভার লেটার টাই দেখবেন। আর তাই কভার লেটার হওয়া উচিত মান সম্মত। এখন, এখানেও আমাদের সমস্যা আছে। আমাকে এই পর্যন্ত অনেকেই ইমেইল এবং ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়েছেন, কভার লেটার এর নমুনার জন্য। কিন্তু ভাই, আমি আপনাকে বলছি, এই ধরনের মুখস্থ কভার লেটার লিখে কাজ পাবেন না। সেই দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কভার লেটার অবশ্যই নিজের হাতে লিখবেন এবং কভার লেটারে শুধু তাই লিখবেন যেটা ক্লাইন্ট জানতে চেয়েছেন। কারন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ক্লাইন্ট তার কাজের সাথে কোন প্রশ্ন যুক্ত করে দেয়, যেমন-
- What part of this project most appeal to you?
- What question do you have about the project?
- What three things do you plan to implement to make the company’s marketing strategy effective?
এই ধরনের প্রশ্ন দেখে অনেকেই ঘাবড়ে যান, ভেবেই পান না কি লিখবেন এর উত্তরে? কিন্তু আপনি কি জানেন, কাজ পাওয়ার জন্য এই প্রশ্ন গুলোই সবচাইতে বড় সহায়ক, এগুলোই হচ্ছে লক্ষভেদের উপায়? এই গুলোর উত্তর যদি সঠিকভাবে দিতে পারেন তাহলে আপনার কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯৫% বেড়ে যায়। কারন এই প্রশ্ন গুলোর মাধ্যমে আপনি ক্লাইন্টকে ওই প্রজেক্ট সম্পর্কে আপনার পরিকল্পনার কথা জানাতে পারেন। আর হ্যা, অবশ্যই অবশ্যই কভার লেটার এবং প্রশ্ন গুলোর উত্তর এমনভাবে দেয়ার চেস্টা করবেন যাতে করে ক্লাইন্ট সেটাতে ইন্টারেস্ট ফিল করে, ক্লাইন্টের মনে যেন এমন ভাবনা আসে যে হ্যা, আপনি কিছু জানেন। আপনাকে দিয়ে কাজটা হবে। যদি ক্লাইন্টের মনে এমন ভাবনা জাগাতে পারেন তাহলেই আপনি সার্থক। সব সময় মাথায় রাখবেন, এমন কাজে বিড করবেন না যেটা আপনি পারেন না, শুধুমাত্র সেই কাজ গুলোতেই বিড করবেন যেটা আপনি পারবেন এবং আপনি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী। আর ক্লাইন্টের সাথে সব সময় ওপেন ভাবে কথা বলুন, এত স্যার স্যার করার কিছুই নেই, এখানে আপনার আর ক্লাইন্টের সম্পর্ক হচ্ছে টাকার সম্পর্ক, সেখানে এত স্যার বলে ডাকার কিছু নেই, আপনি কাজ পারেন ব্যাস করে দিবেন। তাই ক্ল্যাইন্টের সাথে ফ্রেন্ডলী এবং ভাল সম্পর্ক স্থাপনের চেস্টা করুন। শুরুতেই ক্লাইন্টকে বোঝানোর চেস্টা করুন আপনিই তার কাজের জন্য পারফেক্ট এবং আপনি ক্লাইন্টের কাজ সঠিক সময় করে দিতে পারবেন।
আরও একটি সমস্যাঃ
আমাদের আরও একটি সমস্যা হচ্ছে, ধৈর্য্য না থাকা। আমরা মনে করি ২-৩ টা বিড করেই কাজ পেয়ে যাব। কিন্তু আপনি কি নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখেছেন, ক্লাইন্ট যে আপনাকে কাজটি দিবে তার জন্য আপনি নিজে কতটা পারফেক্ট? আমাকে কিছুদিন আগেই এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছি, ভাইয়া আমি ১ মাস ধরে বিড করে যাচ্ছি কিন্তু কাজ পাচ্ছি না। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি কাজ শিখেছেন? উনি বলল, আমি আপনার এসইও ডিভিডি দেখে কাজ শিখেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি প্র্যাক্টিস করেছেন? তিনি বললেন হ্যা করেছি। আমি বললাম কোন ওয়েবসাইটে প্র্যাক্টিস করেছেন? তিনি বলল, আপনার ভিডিও তো দেখেছি, সেখানের সব ই তো সোজা, আমি সব বুঝেছি, আর ক্লাইন্ট কে দেখানোর জন্য আপনি তো কিছু ওয়ার্কপ্রুফ তৈরি করে দেখিয়েছেন ই, ক্লাইন্ট চাইলে সেটা দিয়ে দিব।
এবার বুঝুন, টিউটোরিয়াল দেখে সব বুঝেছেন আর তাই তিনি প্র্যাক্টিস ও করেন নাই, এমনকি ক্লাইন্ট আগের কাজের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে আমাদের এসইও বাংলা টিউটোরিয়াল এ যে কাজের নমুনা আছে সেটা দিয়ে দিবেন, এমন অবস্থায় উনি নিজেকে ভাবছেন উনি এসইও শিখে গেছেন এবং কাজ করে মাসে হাজার হাজার টাকা আয় করবেন? আপনার কি মনে হয়, ক্লাইন্টরা এতই কি বোকা?
আমাদের আরও কিছু সমস্যাঃ
আমাদের আরও সমস্যা হচ্ছে, শোনা কথায় বিশ্বাস করা কিন্তু নিজে যাচাই না করা। আমরা যার মুখ থেকে যেটা শুনি সেটাই বিশ্বাস করি, কেউ হয়ত বলল যে অনলাইনে অমুক কাজ বিড করলেই পাওয়া যায়, তমুক কাজের ভাত নেই, তমুক কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, এই ধরনের আজে বাজে কথায় আমরা সহজেই বিশ্বাস করি কিন্তু বাস্তবতা যাচাই করি না। এর প্রধান কারন হচ্ছে, আমরা কস্ট করতে পছন্দ করি না, লোকের মুখ থেকে শোনা বিভিন্ন কথার মধ্যে যেটা সবচাইতে সহজ এবং সহজে টাকা কামানো যাবে আমরা সেটাই করতে পছন্দ করি। কিন্তু মনে রাখবেন, সহজ বলতে কোন কথা নেই, আবার কঠিন বলতেও কোন কথা নেই, একটাই কথা- সেটা হচ্ছে পরিশ্রম। পরিশ্রম ছাড়া আপনার বা আমার চেহারাখানি যতই সুন্দর হোক না কেন, কেউ এক টাকাও দিয়ে যাবে না।
আশা করি আজকের কথা গুলো কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। সব কথা বড় কথা, দুই একবার চেস্টা করে ব্যর্থ হয়ে গেলেন মানে এই নয় যে আপনি পারবেন না। যদি পরিশ্রম করার মানসিকতা না থাকে তাহলে কোন দিনই সফল হতে পারবেন না। পরিশ্রম করলে সবই সম্ভব। আমি ওইটা পারি না, সেইটা বুঝি না, এই সমস্যা, সেই সমস্যা এই গুলা সব ফালতু বিষয়, এই গুলা যতদিন বাদ দিতে না পারবেন ততদিন কিচ্ছু হবে না। কেউই সব কিছু পেরে দুনিয়াতে আসে না, বিল গেটস তার মায়ের পেটে বসে সফটওয়্যার বানানো শেখে নাই, তাকে পরিশ্রম করেই শিখতে হয়েছে, এবং তিনি পেরেছেন বলেই আজ বিশ্বের সেরা ধনী। অনেকেই তো বলে থাকে সৎ পথে ধনী হওয়া যায় না, কিন্তু তাহলে বিল গেটস তো সঠিক পথেই পৃথিবীর সেরা ধনী হলেন কিভাবে? তিনি আর কারো টাকা চুরি করেন নাই, এটা সম্ভব হয়েছে তার পরিশ্রম এর জন্য। আর তাই আপনিও যদি কিছু করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকেও পরিশ্রম করতে হবে। এর বিকল্প কিছুই নেই। যদি কমপক্ষে ৬ মাস নিজেকে পরিশ্রম করানোর মত সাহস এবং সংযম করতে পারেন তাহলেই সফল হতে পারবেন অথবা, দুনিয়া এগিয়ে যাবে কিন্তু আপনি পেছনেই পড়ে থাকবেন আর শুধু ভাববেন অমুক ভাই ফ্রীল্যান্সিং করে মাসে ৫ লাখ টাকা আয় করে কিন্তু আমি পারিনা। এই ভাবনার শেষ কোনদিনই হবে না। টাকার জন্য না শিখে জ্ঞানের জন্য শিখুন, শেখার সময় টাকার কথা ভুলে যান, ৬ মাস পর দেখবেন টাকা আপনার পেছনে দৌড়াবে। শুধু এটা বিশ্বাস করুন- “আমি পারব এবং অবশ্যই পারব”, আমরাও চাই যেন আমরা পারি, পারতেই হবে, লাল সবুজের দেশ বেকারমুক্ত, কম্পিউটার স্বাক্ষর হবেই হবে ইনশাআল্লাহ। চলুন তাহলে আজ থেকেই শুরু করা যাক ? . . .
লিখাটি সম্পর্কে যে কোন মতামত টিউমেন্ট করে জানাবেন। ভাল থাকবেন সবাই।
No comments:
Post a Comment