ছোটবেলায় গুরুজনেরা আমাকে দুপুরে ঘুমিয়ে থাকতে বলতেন। ভয়ে ভয়ে শুয়ে থাকতাম। কিন্তু মাঠে সমবয়েসীদের খেলাধুলার শব্দ কানে আসতেই পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে দৌড় দিতাম। খেলাধুলার প্রতি ভালোলাগা এত বেশি মাত্রায় ছিল যে গুরুজনের চোখরাঙ্গানি কিংবা শাসন কোনভাবেই আমাকে মাঠের খেলা থেকে দূরে রাখতে পারত না।
এটা আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে ছোটবেলায় আমি মাঠের খেলাধূলাকে যতটা ভালোবাসতাম, বর্তমান প্রজন্মের মানুষ সোস্যাল মিডিয়াগুলোকে, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ‘ফেইসবুক’ কে তার থেকে অনেক বেশি ভালোবাসে! তাই, আমাদের গুরুজন, অর্থাৎ আমাদের সরকার অনেক চেষ্টার পরেও বর্তমান যুগের আধুনিক ছেলে-মেয়েগুলোকে কোনভাবেই ফেইসবুক থেকে দূরে রাখতে পারছে না। অফিশিয়ালভাবে বন্ধ থাকার পরও বাংলাদেশের নাগরিকরা ফেইসবুক ব্যবহার করছে, অন্য দেশের আইপি ব্যবহার করে। মজার ব্যাপার হল, একজন-দুজন নয়, শত-শত ছেলে-মেয়ে এই তালিকায় আছে, কিংবা আমি জানি না- সংখ্যাটা হাজার-হাজারও হতে পারে। তাই ফেইসবুক বন্ধের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এর কার্যকারিতা যে প্রশ্নবিদ্ধ, তা নিয়ে সন্দেহ খুব বেশি থাকছে না। বিশেষ করে গতরাতে বগুড়ার একটি শিয়া মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর। সাধারণভাবে আমরা ধরে নেই যে যারা লুকিয়ে লুকিয়ে ফেইসবুক চালাচ্ছে তারা প্রায় সবাই সাধারণ ছেলে-মেয়ে। এখানে ভাববার বিষয় হল, সাধারণ ছেলে-মেয়েরাই যদি এত সহজে লুকিয়ে ফেইসবুকে একসেস্ পায়, তাহলে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যারা চালায়. তাদের বিষয়ে কি অনুমান করা যায়? অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের অসংখ্য মাধ্যম রয়েছে। এখান থেকে চাইলে তা একঝলক দেখে নেয়া যেতে পারে। আর সন্ত্রাসীরা যেহেতু আমাদের মত সাধারণ মানুষদের থেকে অনেক বেশি স্মার্ট, তাই এই হাতেগোনা কিছু জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করাটা কতটুকু ফলপ্রসূ, তা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ।
ফেইসবুক, ভাইবার, হোয়াটস্অ্যাপ এগুলোর উপকার বেশি না অপকার বেশি- না নিয়ে একটি চমৎকার বিতর্ক হতে পারে। ভালো কাজের পাশাপাশি এইসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে খুব সহজেই খারাপ কাজে ব্যবহার করা যায়। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করা, পাবলিক পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেয়া, সামাজিক ও যৌন হয়রানি করা- এই জাতের ভয়ানক রকম অন্যায় কাজগুলো এইসব সামাজিক মাধ্যমগুলোতে পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে সম্পন্ন করা যায়। কারন পৃথিবীবিখ্যাত এইসব কোম্পানিগুলো কখনওই এর ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে না। বাংলাদেশে সরকার ফেইসবুকের কাছে গতবছর এমন একটি আবেদন করেছিল। কিন্তু ফলপ্রসূ হয় নি।
ফেইসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলো আজকাল শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়। এটা নিশ্চয়ই আমাদের কর্তাব্যক্তিরা জানেন। ফেইসবুক এখন পড়াশোনার জন্যও চমৎকার একটি স্থান। ফেইসবুকে পড়াশোনা করা যায় এমন অনেক গ্রুপ এবং পেইজ আছে। অনেকে এগুলোর সাথে সম্পর্কিত এবং নির্ভরশীল। তারা নিশ্চয়ই এখন সমস্যার মধ্যে আছেন। আবার তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে ফেইসবুক চালাচ্ছেন। ফেইসবুকে ফ্রিল্যান্সিং করা যায়। অর্থাৎ ফেইসবুক ব্যবসারও একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। ফেইসবুকের প্রতি এই ব্যাপক ব্যবসানির্ভরতার কারনে Facebook-commerce বা f-commerce নামে ব্যবসা শাখার আলাদা নামকরণই হয়েছে। বাংলাদেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ ফেইসবুক ব্যবহার করে (আসল সংখ্যাটা ১.৮ কোটি)। e-Commerce Association of Bangladesh (e-CAB) এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭৫০০ ফেইসবুক পেইজ ব্যবসাকাজের সাথে যুক্ত। এ সম্পর্কিত আরও ভারী ভারী তথ্যগুলো জানতে হলেএই লেখাটি পড়তে হবে। তারপর যে কেউই আমাদের ফেইসবুক নির্ভরতার বাস্তব চিত্রটি খুব সহজেই বুঝে ফেলতে পারবে বলে আশা করা যায়।
ফেইসবুক বা এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো কিভাবে আমাদেরকে জড়িয়ে রেখেছে, তা নিয়ে একটি বই লিখে ফেলা যাবে। তাই কিছুদিন পরপর এই কারনে সেই কারনে এইসব মাধ্যম বন্ধ করে দেবার চর্চা কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না।
এবার আসি মাননীয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর কথায়। পত্র-পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা এসেছে। তিনি চমৎকারভাবে, সাবলীল ভাষায় তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া আলোকচিত্রশিল্পী কেভিন কার্টারের কথা বলেছেন, যিনি ১৯৯৪ সালে সুদানে জাতিসংঘের খাদ্য গুদামের কাছে মৃত্যুপথযাত্রী একটি শিশুকে না বাঁচানোর চেষ্টা করে তার মৃত্যুমহূর্তের ছবি ধারণ করেছিলেন। সেই ছবির জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু শিশুটিকে না বাঁচাতে পারার অনুতাপে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে তিনি তাঁর ডায়েরীতে লিখে যান-
“Dear God, I promise I will never waste my food no matter how bad it can taste and how full I may be. I pray that he will protect this little boy, guide and deliver him away from his misery. I pray that we will be more sensitive towards the world around us and not be blinded by our own selfish nature and interests. I hope this picture will always serve as a reminder to us that how fortunate we are and that we must never ever take things for granted.”
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন যে আমরা দিন দিন রোবট হয়ে যাচ্ছি। তিনি আমাদেরকে মানবতার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সবার আগে মানুষের জীবন।
কথাগুলো শতশতাংশ সত্য। এগুলো নিয়ে আমাদের কারও কোন দ্বিমত নেই। মাননীয় প্রতিমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই এত চমৎকার সব কথা বলার জন্য। তবে সামাজিক যোগাযোগের এইসব মাধ্যমগুলো বন্ধ করায় যেসব অসুবিধার তৈরী হয়েছে, সেগুলোর প্রভাব কতটা ব্যাপক- এসব নিয়ে তিনি কিচ্ছু বলেননি। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে জনগণের জীবন বা জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করতে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ- দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা নাকি ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া? মাননীয় প্রতিমন্ত্রী তাঁর লেখায় এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়েছেন। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, বাণিজ্যিক বা আর্থিক ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতির বিষয় হচ্ছে এই পিছিয়ে আসার মানসিকতাটুকু্। জঙ্গীবাদ বন্ধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া নিঃসন্দেহে আমাদের পিছিয়ে পড়াকেই পরিষ্কার করে তোলে।
বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। তাঁরা নিশ্চই জনগনের বৃহৎ স্বার্থে সামাজিক যোগাযোগের এইসব মাধ্যম বন্ধ রেখেছেন। কিন্তু তাঁদের একই সাথে এটাও জানা উচিত যে বন্ধ করার পরও কত সহজে মানুষ আবার এগুলো ব্যবহার করছে। গত ২০১২ সালে একটি স্পর্শকাতর কারনে বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ইউটিউব বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। সেইসময় আমি দেখেছিলাম যে ইউটিউব বন্ধ করে দেয়ার পরও কত সহজে তা একসেস্ করা যায়। প্রথম প্রথম ইউটিউব বন্ধ করে দেবার কারনে অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছিল। প্রথম কিছুদিন ইউটিউবের সক্রিয়ে ব্যবহারকারীরা ব্যাপক অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন তারা জানতে পারলেন যে খুব সহজ একটি বিকল্প উপায়ে ইউটিউব ব্যবহার করা যায়, তখন তাদের দুশ্চিন্তা উবে যায়। ইউটিউব খুলে দেয়ার জন্য তাদের চিৎকার-চেচাঁমেচিও থেমে যায় হঠাৎই!
ইন্টারনেট বা তথ্য-প্রযু্ক্তির এতগুলো ফাঁক-ফোকড় আছে যে বর্তমান দুনিয়ায় একটি ওয়েবসাইটকে পূর্ণরূপে বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। Whatsapp বন্ধ করে কেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঠেকানো যায় না, এগুলো নিয়ে সম্প্রতি New York Times এ একটি লেখা এসেছে। অর্থাৎ ফ্রান্স বা জঙ্গী আক্রমনের ভয়ে থাকা অন্যান্য দেশগুলো Whatsapp বন্ধ করে যে খুব বেশি সুবিধা পাবে না, এই লেখাটি থেকে এটা মোটামুটি পরিষ্কার।
তাই, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া, ইউটিউব বন্ধ করে দেয়া – সন্ত্রাসবাদ বা অপপ্রচার ঠেকাতে এগুলো কখনওই উত্তম বিকল্প হতে পারে না। বরং এগুলো ব্যবহার করেই কি করে সন্ত্রাসীদেরকে ধরা যায়, তার উপায় খুঁজতে হবে কর্তাব্যক্তিদের। এর আগে অন্য দেশের হ্যাকাররা যখন বাংলাদেশের ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক করেছিল, তখন কিন্তু আমরা ভয়ে পিছিয়ে আসি নি। বরং আমাদের দেশের হ্যাকাররা পাল্টা প্রতিরোধ ঘোষণা করেছিল। এবং অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েলও করেছিল। অর্থাৎ, প্রযুক্তির প্রত্যুত্তর কখনও থেমে যাওয়া হতে পারে না। প্রযুক্তির জবাব দিতে হয় প্রযুক্তি দিয়েই।
খুব দ্রুত দেশে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ এবং অপপ্রচার লোপ পাবে, একই সাথে সামাজিক যোগাযোগের বন্ধ হওয়া মাধ্যমগুলোও খুলে যাবে- এমনটা আমরা সবাই আশা করি।
No comments:
Post a Comment